যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি বাড়াতে চায় বাংলাদেশ
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
১৩-০৫-২০২৫ ০১:৪৩:৫০ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
১৩-০৫-২০২৫ ০৪:২৭:৫১ অপরাহ্ন
ফাইল ছবি
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের চাপ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ। এর অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু পণ্যের ওপর শুল্ক হ্রাস এবং আমদানি উৎসের পুনর্বিন্যাসে কাজ শুরু করেছে সরকার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিযোগ্য পণ্যের একটি তালিকা এবং ১০০টি নতুন পণ্যকে শুল্কমুক্ত করার প্রস্তাব চূড়ান্ত করে ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর)-এর দফতরে পাঠানো হবে। এ প্রস্তাব বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ‘মোস্ট ফেভারড নেশন’ (এমএফএন) নীতিমালার আওতায় তৈরি হচ্ছে, ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে দেওয়া শুল্ক হার অন্যান্য সদস্য দেশগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
শুল্ক ছাড়ে যুক্তরাষ্ট্রকেই অগ্রাধিকার:
এক প্রাথমিক নথি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা, এলপিজি, সয়াবিন, গম, প্রাকৃতিক গ্যাস, স্বর্ণ, ভুট্টা, ভ্যাকসিন, জুয়েলারি, বোর্ড ও প্যানেলসহ প্রায় ৪০টি এইচএস কোডের পণ্য আমদানির সম্ভাবনা রয়েছে। এর বাইরেও আরও ১০০টি পণ্যকে শুল্কমুক্ত তালিকায় যুক্ত করার জন্য প্রস্তাবনা তৈরি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এসব পণ্যের বেশিরভাগই বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণে আমদানি করে, তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির পরিমাণ একেবারেই সীমিত। বাংলাদেশের আমদানি পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শক্তিশালী অবস্থান থাকা সত্ত্বেও এসব পণ্যের আমদানি মূলত অন্য দেশ নির্ভর। যেমন, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্ববাজার থেকে ২২২ কোটির ডলার মূল্যের তুলা আমদানি করলেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে মাত্র ৩৩ কোটি ৬৫ লাখ ডলার মূল্যের তুলা। আবার এলপিজির ক্ষেত্রে আমদানি হয়েছে ১৯০ কোটির ডলার, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ মাত্র ৫ কোটি ১৩ লাখ ডলার।
‘বিশেষ সুবিধার’ বার্তা দিতে চায় ঢাকা:
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানান, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি আমদানিযোগ্য পণ্যের একটি তালিকা করা হয়েছে। পাশাপাশি ১০০ পণ্যে শুল্ক ছাড় দিতে এনবিআর কাজ করছে। তার ভাষায়, এই তালিকা চূড়ান্ত করে খুব শিগগিরই ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভের (ইউএসটিআর) দফতরে পাঠানো হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো— যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষা করা এবং এই বার্তার মাধ্যমে আমরা বোঝাতে চাই যে, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।’সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের পাল্টা শুল্ক আরোপের প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ইতিবাচক বার্তা দেওয়ার অংশ হিসেবেই আমদানি উৎসের পুনর্বিন্যাস করছে বাংলাদেশ। এতে বাণিজ্য ঘাটতি যেমন কমবে, তেমনি রপ্তানি আদেশ স্থগিত হওয়া বা মূল্যছাড়ের চাপে থাকা পণ্যগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রে বাড়তি সুবিধা আদায়ের পথও খুলে যেতে পারে।
ট্রাম্পের শুল্ক নীতি ও বাংলাদেশের চাপ:
গত ২ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৫৭টি দেশের পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন। এর আওতায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ বেশ কিছু পণ্যে ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত শুল্ক ধার্য করা হয়। যদিও তা পরবর্তী তিন মাসের জন্য স্থগিত রয়েছে, তবুও ১০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর রয়েছে, যা বাংলাদেশের রপ্তানিতে মারাত্মক প্রতিযোগিতাগত চাপ তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি বাড়ানোর মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস ও কৌশলগত বার্তা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
শুল্কমুক্ত পণ্যের তালিকায় আরও ১০০ পণ্য:
বর্তমানে বাংলাদেশ ১৯০টি পণ্যে শূন্য শুল্ক কার্যকর রেখেছে। নতুন করে আরও ১০০ পণ্যকে শুল্কমুক্ত তালিকায় যুক্ত করতে কাজ করছে এনবিআর। যা কার্যকর হলে আমদানি খাতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। তবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মোস্ট ফেভারড নেশন (এমএফএন) নীতিমালার আওতায় এসব শুল্ক ছাড় অন্য সদস্য দেশগুলোর জন্যও প্রযোজ্য হবে। সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন, এটি কেবল বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কৌশল নয়, বরং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতির বাস্তবতা বিবেচনায় একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এতে করে রফতানিতে শুল্ক ছাড়ের সম্ভাবনা যেমন বাড়বে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে:
গত ৭ মে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) জেমিসন গ্রেয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আলোচনার প্রস্তাব দেন।জেমিসন গ্রেয়ার চিঠিতে বাংলাদেশকে শ্রম অধিকার রক্ষা ও ডিজিটাল বাণিজ্যের ওপর অযাচিত বিধিনিষেধ না দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি জানান, ‘আমার টিম শুল্ক ও অশুল্ক বাধা হ্রাস, কৃষি ও শিল্প খাত উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে প্রস্তুত।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের পক্ষ থেকে লিখিত প্রস্তাব পেলে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু করা যাবে।’ এর আগে, ৭ এপ্রিল শেখ বশিরউদ্দীন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে উদ্যোগ নেওয়ার আগ্রহ জানিয়ে একটি চিঠি পাঠান।
জেনারেল মোটরস ও বোয়িংকে অগ্রাধিকার:
সরকার চায়, দক্ষিণ কোরিয়া বা ভারতের পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি পণ্য আমদানির হার বাড়াতে। উদাহরণস্বরূপ, জেনারেল মোটরস-এর গাড়ি এবং বোয়িং-এর তৈরি উড়োজাহাজ আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এলএনজি ও অন্যান্য প্রযুক্তিপণ্য সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনার উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে।
অশুল্ক বাধা দূরীকরণে প্রতিশ্রুতি:
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের অংশ হিসেবে অশুল্ক বাধা কমানো এবং মার্কিন বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির দিকেও নজর দিচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি কোম্পানির বকেয়া পরিশোধ করেছে এবং ওরাকলের পাওনা মেটাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাশাপাশি, অশুল্ক বাধা যেমন—নকল সফটওয়্যার ব্যবহার, বিনিয়োগ বিধিনিষেধ, মান নির্ধারণ জটিলতা ইত্যাদি দূরীকরণেও সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেও জানানো হয়েছে।
বাংলাস্কুপ/প্রতিবেদক/এনআইএন
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স